বাঙালির ভৌতিক চর্চা বা ভূত চর্চা বা পরলৌকিক চর্চা নিয়ে কিছু তথ্য ও কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করা যাক। ভূত আছে কি নেই, সেটা বিতর্কিত বিষয়, কিন্তু কিছু অনুভবের বিষয় বঙ্গদেশের বেশ কিছু বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব তাঁদের লেখনীতে লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন, এবং সেগুলো অবশ্যই গল্প নয়।
ভূতচতুর্দশী ও বাঙালির ভুতেরা !!
উনবিংশ শতাব্দীতে কলকাতা শহরেও মৃতের সঙ্গে কথোপকথন শুরু হয়েছিল। ইতিহাস বলছে, ১৮৬৩ সালে কলকাতায় যখন প্রথম প্রেতচক্র অনুষ্ঠিত হয়, তখনও সোসাইটি অফ সাইকিক রিসার্চ রয়েছে ভবিষ্যতের গর্ভে। প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন এক বিখ্যাত মানুষ, বেঙ্গল লাইব্রেরির মুখ্য গ্রন্থাগারিক প্যারীচাঁদ মিত্র। বাংলা সাহিত্যের ছাত্র ও অনুরাগীদের মনে পড়বে, ইনিই টেকচাঁদ ঠাকুর ছদ্মনামে উনিশ শতকের সাড়া জাগানো বই ‘আলালের ঘরের দুলাল’ লিখেছিলেন। প্রেতচর্চায় তাঁর আগ্রহের কারণ ১৮৬০ সালে তাঁর স্ত্রীবিয়োগ। অকস্মাৎ মনের মানুষটিকে হারিয়ে তিনি বিশেষ কাতর হয়ে পড়েছিলেন এবং বিদেশ থেকে প্রেততত্ত্বের বই আনিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। বেরিনি নামে এক ফরাসি বিশেষজ্ঞের রচনা থেকে তিনি প্লানচেট মারফৎ আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায় জানতে পারেন এবং এর পরে নিয়মিত চক্রে বসে প্ল্যানচেট করার সঠিক পদ্ধতিও আবিষ্কার করেছিলেন। মনে হয়, তাঁর প্ল্যানচেট গবেষণার ফল ভালই হয়েছিল। কারণ গল্প আছে, তাঁর মৃতা স্ত্রী নাকি প্রত্যহ দু’বেলা তাঁর স্বামীর আহারের তদারক করে যেতেন এবং রান্নায় নুন-মিষ্টি কমবেশি হলে পূত্রবধূদের উপরে চোটপাটও করতেন। ওই সময়েই কলকাতা থেকে খুব বেশি দূরে নয়, যদিও এখন বাংলাদেশের অঙ্গ, যশোহর টাউনে, একটি সান্ধ্য প্রেতচক্র গড়ে উঠেছিল, যার সদস্য ছিলেন অনেক সরকারি কর্মচারী। দু’জন বিখ্যাত মানুষ— নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র ও সাহিত্যিক তথা বঙ্কিমচন্দ্রের অগ্রজ সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এই প্রেতচক্রে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন। ‘নীলদর্পণ’ ও ‘পালামৌ’-র স্রষ্টারা অবশ্য কোনও মৃত্যুশোক ভুলতে বা আধ্যাত্মিক গবেষণা করতে আসর জমাতেন না। প্ল্যানচেট ছিল এঁদের কাছে নিছক বিনোদন। এক সন্ধ্যায় প্ল্যানচেটের আসরে একটি আত্মার আগমনে শহরে খুবই হৈ চৈ পড়ে গিয়েছিল। চক্রধারীরা দাবি করলেন, বিনা আহ্বানেই হাজির হয়েছিলেন কবি জন মিল্টনের আত্মা এবং নিজের মিল্টনত্ব প্রমাণ করার জন্য ল্যাটিনে এক পিস কবিতাও লিখে দিয়েছিলেন। চক্রধারীরা কেউই ল্যাটিন জানতেন না, তাই তাঁরা তখনকার মতো কিছুই না বুঝে ভূতকে প্রচুর সাধুবাদ দিয়ে বিদায় দিয়েছিলেন। ক’দিন পরে অবশ্য এক ল্যাটিন বিশারদকে লেখাটা দেখানো হয় এবং তিনি পড়ে বলেন— কবিতাটি অতি নিম্নশ্রেণীর, তাতে নাকি ব্যকরণের ভুলও রয়েছে। ‘অ্যারিওপ্যাজেটিকা’-র লেখকের কলম থেকে এমন কবিতা বেরোনো নিঃসন্দেহে বিস্ময়ের। চক্রধারীরা তখন খুশি হয়ে প্রচার করেন, মিলটন না হলেও একটা কোনো আত্মা অবশ্যই এসেছিল, নইলে ল্যাটিন ভাষায় লিখলো কে?
আলিপুর বোমা মামলা।
প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট ডগলাস কিংসফোর্ডকে মারার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে অনেকের সঙ্গেই ধরা পড়েছেন অরবিন্দ ঘোষ, বারীন ঘোষরা। অভিযুক্তদের হয়ে মামলা লড়ছেন ব্যারিস্টার ব্যোমকেশ চক্রবর্তী। মামলা শুনছেন বিচারপতি বিচক্রফ্ট। ও দিকে, সে সময় ভূতপ্রেত নিয়ে মেতে আছেন আর এক ব্যারিস্টার, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। কখনও পুরুলিয়ায়, কখনও কলকাতায় তাঁর রসা রোডের বাড়িতে বসছে আত্মা-আনয়ন চক্রের বৈঠক। নাটোরের মহারাজা জগদীন্দ্রনাথ রায়ও সাধারণত থাকেন সেই সব বৈঠকে। বন্ধ দরজার ভিতর দিয়ে বাড়ির ছোটরা পরলোক থেকে নেমে আসা অশরীরীদের আভাস পাওয়ার চেষ্টা করে।আলিপুর মামলা নিয়ে কিছু আলোচনার জন্য একদিন ব্রাহ্মবান্ধবের আত্মাকে ডেকে আনলেন দেশবন্ধু। আত্মা পেন্সিল দিয়ে বারবার লিখে দিল, ‘‘ইউ মাস্ট ডিফেন্ড অরবিন্দ।’’ কিছু দিনের মধ্যে আলিপুর বোমা মামলা চলে এল দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের হাতে।
বরোদা।
উনিশ শতকের একেবারে গোড়ার দিক। ভাই বারীনের সঙ্গে আত্মা ডেকে আনার আসর বসাতেন অরবিন্দ ঘোষ। পণ্ডিচেরিতে শ্রীঅরবিন্দ এক সময় নিয়মিত বসতেন ‘সেঅন্স’ অর্থাৎ আত্মার সঙ্গে যোগাযোগের বৈঠকে। তেমনই কয়েকটা আসরে, প্রায় সাত-আট দিন লিখে তিনি ইংরেজিতে শেষ করলেন একটি বই। নাম দিলেন ‘যোগিক সাধন’। নিজে লিখলেও বইয়ে নিজের নাম ছাপতে দিলেন না ঋষি অরবিন্দ। কেন? বললেন, তাঁর হাত দিয়ে আসলে অন্য কেউ এসে লিখে গেছেন সেই বই। প্রেত-তাত্ত্বিকরা একেই বলবেন ‘স্বয়ং-লিখন’।
লেখালেখির পাশাপাশি, পেশায় আইনজীবী সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় তখন বন্ধুদের নিয়ে মেতে আছেন প্রেতচর্চায়।
হীরেন্দ্রনাথ দত্ত আর সৌরীন্দ্রের মেজকাকা রাজেন্দ্রলাল মুখোপাধ্যায় সেই সময় সম্পাদনা করেন ‘থিওসফিকাল সোসাইটি’র পত্রিকা ‘পন্থা’। তিন পায়া টেবিলকে ঘিরে ধরে আত্মা নামানোর চক্র বসাতেন সৌরীন্দ্রমোহন, যার চলতি নাম ছিল ‘টেবল টার্নিং’। আত্মা এলে কেঁপে উঠত টেবিলের পায়া। পায়া কতবার পা ঠুকল মাটিতে, সেই অনুযায়ী ধরা হত আত্মার উত্তর। ‘‘রহিম সাহেবের জজ হওয়ার সম্ভাবনা আছে কি?’’ প্রেতচক্রে এই প্রশ্নের উত্তরে টেবিলের পায়া একবার শব্দ করল। তাতেই স্পষ্ট হল জবাব— ‘‘হ্যাঁ।’’ পরে এই ‘হ্যাঁ’টা মিলেও যায়। ওঁদের প্রেতচক্রে আর একবার এল স্বয়ং ছত্রপতি শিবাজির আত্মা। তাকে প্রশ্ন : ভারত কোনও দিন স্বাধীন হবে কি না। আবার এক বার পায়ার ঠোক্কর মাটিতে। অতএব— ‘‘হবে।’’ তখন প্রশ্ন, কত দিন পর? টেবিলের পায়া ঠক ঠক ঠক করে চলল—চল্লিশবার। উপস্থিত চক্রীদের কেউ সে দিন বিশ্বাস করেননি, চল্লিশ বছরের মধ্যেই সত্যি সত্যি স্বাধীন হয়ে যাবে ভারতবর্ষ।
ঠাকুরবাড়ি।
রবীন্দ্রনাথের দিদি স্বর্ণকুমারী দেবী সম্পাদনা করতেন মাসিক পত্র ‘ভারতী’। হঠাৎ তাঁর স্বামী জানকীনাথ ঘোষাল মারা গেলেন। এর পর যাবতীয় কাজকম্ম যেন স্বর্ণকুমারীর কাছে ভার হয়ে দাঁড়াল। সমস্ত কিছু থেকে অব্যাহতি চেয়ে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইলেন তিনি। তখন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়িতে প্রেতবৈঠক বসে। সেখানে মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায় ডাকলেন জানকীনাথের আত্মাকে। কৌতূহলী প্রেতচক্রীদের প্রশ্ন— এর পর ‘ভারতী’র কী হবে?জানকীনাথের আত্মা জানাল, একদিন সৌরীন্দ্রনাথ আর মণিলাল দ্বায়িত্ব নেবেন ‘ভারতী’র। সে-কথাটাও মিলে ছিল অক্ষরে অক্ষরে। ‘ভারতী’র সম্পাদক হয়েছিলেন ওই দুজনে।
বড় ছেলে মারা গেলে, বউয়ের আবদারে, প্ল্যানচেটে বসলেন সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী।
মনে কিন্তু শুধুই অবিশ্বাস আর সন্দেহ। কিছু দিন যেতেই সেই সতীশচন্দ্রই ‘বুঝলেন’, ভাল মন নিয়ে ডাকলে আত্মারা আসে। আরও বুঝলেন, ঐহিক বিষয় নিয়ে জ্বালাতন আত্মারা পছন্দ করে না। আত্মাদের সঙ্গে নিজের কথাবার্তা বারবার পড়ে তিনি এতটাই খুশি হয়ে পড়তেন যে, এক বার লিখেছিলেন, যেন ‘‘ধর্মপুস্তক পাঠ করিবার পবিত্র আনন্দ উপভোগ করি।’’ সতীশচন্দ্রের আত্মাচর্চা প্রেতচক্রের গল্পে আত্মার ভোজন-পর্বের কথাও এসে পড়ে। অবাক করা সে সব কাহিনির দু’-একটা নমুনা দেওয়া যাক। দেখা যাচ্ছে, মৃত পুত্র পরিতোষের আত্মা এসে একবার সতীশচন্দ্রকে জানাচ্ছে, ‘‘মৃত্যুর পূর্বে ডাব খাইতে চাহিয়াছিলাম।’’ সতীশচন্দ্র বিলক্ষণ জানতেন, জীবদ্দশায় পরিতোষ চমচম ভালবাসত। ছেলের আত্মাকে বাবা বললেন, ইদানীং স্পঞ্জ রসগোল্লা পাওয়া যাচ্ছে, যা পরিতোষের মৃত্যুর সময় বাজারে ছিল না।পরিতোষের আত্মাকে সতীশচন্দ্র জিজ্ঞাসা করলেন, স্বর্গে ‘‘তুমি কি স্পঞ্জ রসগোল্লার আস্বাদ পাইবে?’’ উত্তর এল, ‘‘না। সাধারণ রসগোল্লার তৃপ্তি পাইব।’’ প্রেত অধিবেশনের শেষে সতীশচন্দ্র লিখে রাখলেন অভ্রান্ত উপসংহার: ‘‘বুঝিলাম আত্মারা স্মৃতির সাহায্যে আস্বাদজনিত তৃপ্তি পাইয়া থাকে।’’ এর পরের আরেক ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে অন্য এক জায়গায়। তাতে দেখা যাচ্ছে, সতীশচন্দ্রের প্রেতচক্রে নয় জন বিদেহী আত্মা ডাব ও আম দিয়ে ভোজ সারছেন। আর ছেলের উদ্দেশে নিবেদিত চমচম, অনাহুত আত্মা নিঃশেষ করে দিলে, ছেলের আত্মা প্রেতচক্রে ধরা দিয়ে বলছে, ‘‘তারা শালা সব নষ্ট করিয়াছে।’’
শুধু তাই নয়, আকস্মিক মৃত্যুর পর প্রেতচক্রে একবার নেমে এলেন পাড়ায় ‘ছোড়দি’ বলে পরিচিত জনৈক হেডমাস্টারের ভ্রাতুষ্পুত্রী। চক্রে তিনি এমন ‘চপলতা’ প্রকাশ করলেন যে, সতীশ্চন্দ্রের ঠোঁট স্পর্শ করে ফেলল আবির্ভূত মহিলার কান। বিব্রত সতীশচন্দ্র বলে উঠলেন, ‘‘ছি: ছোড়দি!’’ হাসতে হাসতে হাততালি দিয়ে সেই আত্মা বলল, ‘‘এখন আপনি বকুন আর মারুন, কিছুতেই আমার আপত্তি নাই। আমি আমার কাজ হাসিল করিয়া লইয়াছি!’’
‘আনন্দের সম্বন্ধ’’ আর ‘মিলনের আকাঙ্ক্ষা’
নারী আর পুরুষের ‘আনন্দের সম্বন্ধ’’ আর ‘মিলনের আকাঙ্ক্ষা’ পরলোকেও কি দেখা যায়? নিজস্ব প্রেতচক্রে একবার মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের আত্মার কাছে জানতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে প্ল্যানচেটের রীতিমতো চল ছিল। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য ঘটনাবলির মধ্যে দুটি চিঠির উল্লেখ করা যায়। মাইকেল মধুসূদন দত্তের বিষয়ে কিছু মনে আছে কি না, জানতে চাওয়ায় প্রমথনাথ বিশিকে রবীন্দ্রনাথ এক চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘‘আমি তাঁকে দেখিনি, একবার প্রেতবাণী চক্রযানে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, সেটা আদালতে সাক্ষ্যরূপে গ্রাহ্য হবে না।’’ ১৯২৯-এ রানি মহলানবিশকে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘‘সেদিন বুলা এসেছিল। হঠাৎ কথায় কথায় প্রকাশ পেল তার হাতে প্রেতাত্মা ভর করে, পেন্সিল চালিয়ে কথা কইতে পারে। বলা বাহুল্য শুনে মনে মনে হাসলাম. বললুম— আচ্ছা দেখা যাক।’’ সে বছরেরই শেষের দিকে শান্তিনিকেতনের উদয়ন আর জোড়াসাঁকোর বাড়িতে প্রায় দু’মাস, ধারাবাহিকভাবে তাঁর বিদেহী প্রিয় বন্ধু ও আত্মীয়দের ডেকে এনে কথা বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।নানা সময় তাঁর সঙ্গে থাকতেন অবনীন্দ্রনাথ, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ, অজিতকুমার চক্রবর্তী ও অন্য কেউ কেউ।বন্ধু মোহিতচন্দ্র সেনের কবি ও সুন্দরী কন্যা উমা ছিলেন সেই সব অতীন্দ্রিয় অধিবেশনের ‘মিডিয়াম’। যার ডাক নাম ছিল বুলা। মাত্র সাতাশ বছর বয়সে মারা যান তিনি।নতুন বৌঠান কাদম্বরী, স্ত্রী মৃণালিনী, পুত্র শমী, কন্যা মাধুরীলতা, নতুনদাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মতোই প্রেত-অধিবেশনে একদিন এলেন বিদেহী সুকুমার রায়। তাঁর গানের সমঝদার সুকুমারের অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ ধরলেন ‘তরী আমার হঠাৎ ডুবে যায়…’। মাঝপথে থেমে গেলেন গানটার কথা ভুলে! সুকুমারের আত্মা রবীন্দ্রনাথকে প্রশ্ন করে বসল, ‘‘আমার ছেলেকে আপনার আশ্রমে নিতে পারেন?’’ সুকুমারের এই ইচ্ছের কথা তাঁর স্ত্রী সুপ্রভাকে জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং। এই কথা শুনে কিছু দিন ছেলেকে নিয়ে কবির শান্তিনিকেতনে কাটিয়েও যান সুপ্রভা। কিন্তু সদ্য বাবা-হারানো ছেলেকে কী ভাবে আর একা ছেড়ে আসেন সেখানে! কিন্তু এর ঠিক দশটা বছর পর দেখা যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের আশ্রমে সত্যজিৎকে পড়তে পাঠিয়ে দিচ্ছেন সুপ্রভা রায়।
স্বামী বিবেকানন্দের উৎসাহে স্বামী অভেদানন্দ,
আঠেরো শতকের শেষে পাশ্চাত্যে গিয়েছিলেন বেদান্ত দর্শন প্রচার করার জন্য। আমেরিকার প্রথম সারির প্রেততাত্ত্বিকের সঙ্গে তাঁর ভাবনার আদানপ্রদান হয়। প্রায় দুই দশকের প্রবাসজীবনে পাশ্চাত্যের প্রখ্যাত পরলোকচর্চার কেন্দ্রগুলোতে দেওয়া তাঁর বক্তৃতা সমাদৃত হয়েছিল। মরণের পরে আত্মা কোথায় যায়, এই প্রশ্নের উত্তরে সাংখ্যকার কপিল আর অন্যান্য হিন্দুদার্শনিকদের সুরেই একবার অভেদানন্দ বলেছিলেন, মৃত্যুর পর পঞ্চপ্রাণ, পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয়, পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধির মতো সতেরোটা উপাদানে তৈরি সূক্ষ্মদেহ ধারণ করে আত্মা যায় স্বপ্নলোকের মতোই মনলোকে।
মালদহের ইংরেজবাজারের কলাতলা।
সেখানে শনিবারের চিঠির সম্পাদক সজনীকান্ত দাসের মেজদা অসুস্থ। সেবা চলছে পালা করে। সজনীকান্তকে ঘুম থেকে তুলে দাদার পাশে বসিয়ে বাবা গেলেন ছাদে আর গিয়েই বললেন, ‘‘আজই সব শেষ হয়ে যাবে।’’ শেষ রাতে ছেলের মাথার কাছে লাল আলো দেখলেন বাবা। বিছানায় উঠে বসে ছেলে বলল, ‘‘আমি যাচ্ছি।’’ তারপরই উধাও সেই লাল আলো। পরদিন দুপুরের আগেই মারা গেলেন মেজদাদা।
আচার্য ব্রজেন্দ্রলাল শীল মৃত্যুর পর জরুরি কাগজপত্র খুঁজে পেয়েছিলেন প্রয়াত স্ত্রীর স্বপ্নে দেখানো ঠিকানায়। জ্যোতিষশাস্ত্রের মতোই প্ল্যানচেটে আস্থা রেখেছিলেন সাহিত্যিক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়।
প্রয়াত স্ত্রী গৌরীর সঙ্গে কথা বলতেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
বিদ্যালয়ে উৎসাহীদের নিয়ে প্ল্যানচেটের আসর বসিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ আর জেলাপ্রশাসনের প্রশ্নের মুখে পড়েছিলেন। তার জেরেই শেষ পর্যন্ত তাঁকে খোয়াতে হয়েছিল হুগলি জেলার জঙ্গিপাড়ার দ্বারকানাথ হাইস্কুলের চাকরি। শুধু তাই নয়, প্ল্যানচেটে মা মৃণালিনীর সম্মতি পেয়ে স্ত্রী-হারা বিভূতিভূষণ রাজি হয়ে যান বয়সে সাতাশ বছরের ছোট, তাঁর প্রেমে হাবুডুবু, কল্যাণীর সঙ্গে দ্বিতীয় বিয়েতে। মৃত্যুর আগে ধারাগিরিতে বেড়াতে গিয়ে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনে এক অদ্ভুত কাণ্ড ঘটেছিল। শোনা যায়, এক মৃতদেহের চাদর সরিয়ে তিনি আঁতকে উঠেছিলেন তাঁর নিজেরই মুখ দেখতে পেয়ে!
প্ল্যানচেট কিন্তু আসলে ছিল প্রেতচক্রে ব্যবহার করা এক যন্ত্র। ১৯০৮ সালে ছাপা, সুরেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য তাঁর বই ‘প্রেত-তত্ত্ব’-য় প্ল্যানচেট যন্ত্রের বর্ণনা দিয়েছেন এইভাবে : ‘প্ল্যানচেটের আকার পানের ন্যায়। এক খানি কাষ্ঠনির্মিত সিকি ইঞ্চি বেধবিশিষ্ট তক্তাদ্বারা নির্মিত। তক্তার একদিকে একটি শিসক পেন্সিল সংলগ্ন থাকে, অপর দুইদিকে বোতামের ন্যায় দুইখানি হাড়ের চাকা এমন কৌশলের সহিত সংলগ্ন থাকে যে, ঐ যন্ত্র যে দিকে ইচ্ছা অনায়াসে নড়িতে পারে।’ উনিশ শতকের গোড়ার দিকে, কলকাতার পঞ্জিকায় পাতা-জোড়া বিজ্ঞাপন দিয়ে ফকিরচাঁদ চক্রবর্তী লেনের এফ.সি সরকার মাশুল-সমেত তিন টাকায় বিক্রি করতেন ‘প্ল্যানচেট বা অতি আশ্চর্য্য ভৌতিক যন্ত্র’।
২০ কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটে ছিল অবনীন্দ্রনাথের জামাই, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের নতুন ছাপাখানা। ‘কান্তিক প্রেস’। তার দোতলার ঘরে বসত প্ল্যানচেটের আসর। থাকতেন কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, সাহিত্যিক চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। একদিন সেখানেই প্রেত-অধিবেশনে এল রবীন্দ্রনাথের প্রিয়, শান্তিনিকেতন আশ্রমবিদ্যালয়ের অকালপ্রয়াত শিক্ষক সতীশচন্দ্র রায়ের আত্মা। আত্মা জানাল, আসরে উপস্থিত সকলের মধ্যে স্বল্পায়ু অজিতকুমার চক্রবর্তী মারা যাবেন সকলের আগে।সত্যিই অজিতের মৃত্যু হয়েছিল অকালেই। ইনফ্লুয়েঞ্জায়। কলকাতা শহরে। প্রেতচর্চার বিষয়ে ‘কান্তিক প্রেস’ থেকে ছাপা মণিলালের বই ‘ভুতুড়ে কাণ্ড’ তুমুল জনপ্রিয় হয়।আত্মারা মানুষের ডাকাডাকিতে উত্যক্ত হয় জানিয়ে মণিলালের চক্রে হাজির হওয়া এক আত্মা বলেছিল, ‘‘দেখো, আজ তোমরা প্রেতাত্মা লইয়া নাড়াচাড়া করিতেছ, অনেককে তোমরা শাস্তির ভাগী করিতেছ; যখন তোমাদের মৃত্যু হইবে,—তখন সেই সব আত্মা তোমাদের উত্যক্ত করিবে, — তোমাদের লইয়া ছেঁড়াছিঁড়ি করিবে।’’
‘জীবনস্মৃতি’- তে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, পরলোকের ব্যবস্থা কেমন, গুরুজনেরা প্ল্যানচেটযোগে একবার স্বভাব-রসিক কৈলাসকে এই প্রশ্ন করলে উত্তর এসেছিল, ‘‘আমি মরিয়া যাহা জানিয়াছি আপনারা বাঁচিয়াই তাহা ফাঁকি দিয়া জানিতে চান? সেটি হইবে না।’’