
মুম্বাইয়ের মালাড অঞ্চলের একটি বাড়িতে প্রায়শই ভিড় জমাতেন সিনেমা জগতের রথী মহারথীরা। কখনও আসতেন শচীন কত্তা, কখনও দিলীপ কুমার, হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়। আসছেন, থাকছেন; কখনও খেয়েও যাচ্ছেন। বাড়ির বাইরে একটি নেমপ্লেট, তাতে লেখা ‘এস ব্যানার্জি’। কিন্তু জল হাওয়া যেন সহ্য হল না। পরিবার নিয়ে ওই ব্যক্তি চলে এলেন পুনে শহরে। এবার যেন অদ্ভুত একটা আনন্দ পেলেন। কারণ কী? আর কিছুই না, ভদ্রলোকের একটু লেখালেখির শখ কিনা! আবারও শব্দের ঝড় এসেছে তাঁর। মাথায় গিজগিজ করছে প্লট। লিখেই ফেললেন। গল্পের দুটি চরিত্র ছিল এতদিন। এবার নতুন একটি চরিত্র জন্ম নিল। মহিলা চরিত্র। ভদ্রলোক ডায়েরিতে খুশি মনে লিখলেন, “পনেরো বছর পরে আবার ব্যোমকেশের গল্প লিখিলাম!” বাংলার পাঠক মহল এবার আর ভুল হতেই পারেন না। এই ব্যক্তিটি যে তাঁদের শ্রদ্ধার মানুষ! এভাবেই হেরে গিয়েও বারবার জন্ম নিয়েছেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। জন্ম নিয়েছে ব্যোমকেশ। ওহ, গল্পের ওই নারী চরিত্রটিকে নিশ্চয়ই চিনতে পেরেছেন? হ্যাঁ, সত্যবতী। গল্পটা? ‘অর্থমনর্থম’!
১৯৩২ সালে আবির্ভূত হল ব্যোমকেশ | বসুমতী পত্রিকায় বেরোল তিনটি গল্প | ‘পথের কাঁটা’, ‘সীমন্তহীরা’ আর ‘সত্যান্বেষী’। পরের বছর এর সাথে ‘মাকড়সার রস’ গল্পটি যুক্ত হয়ে প্রকাশিত হল ব্যোমকেশের প্রথম বই, ‘ব্যোমকেশের ডায়েরি’। বাংলা সাহিত্য পেল এক নতুন সৃষ্টি | অজিত, অতুল, হ্যারিসন রোডের মেস বাংলা সাহিত্যে অমর হল | ব্যোমকেশ নিছক গোয়েন্দা কাহিনী নয় | তা ছিল সমসাময়িক সমাজের জীবন্ত দলিল | ব্যোমকেশ এক ব্যতিক্রম | যেখানে ছিল সময়ের ছাপ, দেশের কথা, সমাজের কথা | তিনি নিজেও বলতেন ‘‘ব্যোমকেশের গল্পে যদি সাহিত্যরস না থাকিয়া শুধু thrill ও শস্তা sensation থাকে, তবে সাহিত্যবিচারকগণ তাহাকে দ্বীপান্তরিত করুন, আপত্তি নাই। কিন্তু যদি তাহা থাকে, তবে শুধু ডিটেকটিভ বলিয়া তাহাকে শাস্তি দিবার অধিকার কাহারো নাই।’’১৯৩২ সালে আবির্ভূত হল ব্যোমকেশ | বসুমতী পত্রিকায় বেরোল তিনটি গল্প | ‘পথের কাঁটা’, ‘সীমন্তহীরা’ আর ‘সত্যান্বেষী’। পরের বছর এর সাথে ‘মাকড়সার রস’ গল্পটি যুক্ত হয়ে প্রকাশিত হল ব্যোমকেশের প্রথম বই, ‘ব্যোমকেশের ডায়েরি’। বাংলা সাহিত্য পেল এক নতুন সৃষ্টি | অজিত, অতুল, হ্যারিসন রোডের মেস বাংলা সাহিত্যে অমর হল | ব্যোমকেশ নিছক গোয়েন্দা কাহিনী নয় | তা ছিল সমসাময়িক সমাজের জীবন্ত দলিল | ব্যোমকেশ এক ব্যতিক্রম | যেখানে ছিল সময়ের ছাপ, দেশের কথা, সমাজের কথা | তিনি নিজেও বলতেন ‘‘ব্যোমকেশের গল্পে যদি সাহিত্যরস না থাকিয়া শুধু thrill ও শস্তা sensation থাকে, তবে সাহিত্যবিচারকগণ তাহাকে দ্বীপান্তরিত করুন, আপত্তি নাই। কিন্তু যদি তাহা থাকে, তবে শুধু ডিটেকটিভ বলিয়া তাহাকে শাস্তি দিবার অধিকার কাহারো নাই।’’
বাবা ছিলেন মুঙ্গেরে। সেখানকার জাঁদরেল উকিল তিনি। সাধারণত এইসব ক্ষেত্রে যা হয়ে থাকে, এবারেও তাই হল। বাবা তারাভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইচ্ছা, ছেলে তাঁরই মতো উকিল হোক। কিন্তু ছেলের যে আইনি ব্যবসায় অত মন নেই। তখন সাহিত্য, বাংলা ভাষা তাঁকে আঁকড়ে ধরেছে। ছোটো থেকেই বাড়িতে ছিল বোঝাই বইপত্র। ছড়া, কবিতা, উপন্যাস— সব পড়তে আরম্ভ করেন। এমন সময় স্কুলে মাস্টারমশাই সবাইকে বললেন কবিতা লিখতে। ব্যস, সেখান থেকে ‘লেখার ভূত’টাও এসে চাপল ঘাড়ে।
কিন্তু কথায় বলে না, অবস্থায় পড়লে মানুষ সব কিছু ভুলে যায়। এখানেও সেটাই হতে যাচ্ছিল। বাস্তবতা যখন আঘাত করল, তখন তরুণ শরদিন্দু আর থই পেলেন না। ইতিমধ্যেই বাবা নিজের পছন্দ করা পাত্রীর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। একটি ছোট্ট কবিতার বইও বেরিয়ে গেছে, নাম ‘যৌবনস্মৃতি’। কিন্তু ভবিষ্যত চলবে কী করে? বাবার এই প্রশ্নের জবাব খুঁজে পেলেন না। বাধ্য ছেলের মতো গেলেন আইন পড়তে। কিন্তু এসব জিনিস যে তাঁর বড়ো অপছন্দের! ছেড়ে দিলেন একসময়; কিন্তু পরিস্থিতি আবারও তাঁকে আইনের রাস্তাতেই নিয়ে এল। বাবার জুনিয়র হিসেবে কাজ করতে শুরু করলেন।
এই বিশাল ঝড়ের ভেতর থেকেই যে নিজের দিশা খুঁজে পায়, সেই তো আসল লোক! শরদিন্দু এই আবর্তের মধ্যে পড়েই বুঝলেন, লেখা ছাড়া তাঁর পক্ষে থাকা অসম্ভব। কাজ হয়তো পরে ঠিকই জুটে যাবে একটা; কিন্তু লেখা ছাড়লে বাঁচা মুশকিল। এদিকে স্বীকৃতিও যে পেতে আরম্ভ করেছেন! ঠিক করলেন, আর না। সাহিত্যের মন্দিরেই বরং আশ্রয় নেওয়া যাক।
শরদিন্দু বলতেই গোটা বাঙালির তিনটে জিনিস মনে পড়ে। ভূতের গল্প, ঐতিহাসিক উপন্যাস আর অবশ্যই, ব্যোমকেশ। শরদিন্দুর আগেও গোয়েন্দারা ছিলেন সাহিত্যে; ‘দারোগার দপ্তর’ই তো রমরমিয়ে চলত। পরেও ফেলুদার মতো আরও গোয়েন্দারা এসেছেন। কিন্তু ব্যোমকেশের মতো একটিও না। একটা প্রচলিত কথাই হল, ‘ছোটো বয়সে ফেলুদা, বড়ো হলে ব্যোমকেশ’। শুধুমাত্র গোয়েন্দা কাহিনি নয়; সেই সময়ের ভারতের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট, ঘরের চিত্র, মানসিক জগত সবকিছু উঠে এসেছিল বইয়ের পাতায়। ব্যোমকেশ শুধু কঠিন কঠিন রহস্যই সমাধান করে না, সত্যবতী রাগ করে চলে গেলে সেখানেও তাঁর মান ভাঙাতে যায়। অবশ্য এই লেখাটা লিখতে লিখতে একটু ভুল হয়ে গেল। একটু নয়; বলা ভালো মারাত্মক। ব্যোমকেশ কি গোয়েন্দা? শরদিন্দু স্বয়ং তাঁরই মুখ দিয়ে বলিয়ে নিচ্ছেন, না তা নয়। ও হল সত্যান্বেষী! তৎকালীন ভারতের একটি খণ্ডচিত্রও অপরাধীর সঙ্গে উঠে আসে পাঠকের কাছে। যেখানে ‘চিত্রচোর’-এ প্রেমিক প্রেমিকাকেও মিলিয়ে দিচ্ছেন তিনি। সেই ১৯৩২ সাল থেকে যে স্বাদ বাঙালি পাঠকরা পেয়ে আসছেন…
ব্যোমকেশের পাশাপাশি ঐতিহাসিক উপন্যাসেও নিজের জাত চিনিয়েছেন শরদিন্দু। অবশ্য শুরুতে নিজেই বলে দিচ্ছেন- “ইতিহাস থেকে চরিত্রগুলো কেবল নিয়েছি; কিন্তু গল্প আমার নিজের।” কিন্তু তাঁর বহুধাবিস্তৃত এই উপন্যাস, গল্পগুলোর মধ্যে দিয়েই পাঠক ধরতে পারেন সেই সময়কে। সে ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ই হোক, বা ‘চুয়াচন্দন’; ইতিহাসের ঘটনার ঘনঘটা যেন সামনে উঠে আসে। স্বয়ং সুকুমার সেন বলেছেন, “প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত শরদিন্দুবাবুর ঐতিহাসিক গল্পের কালপ্রসার। এর মধ্যে কোথাও গল্পের পরিবেশ গল্পরসের তীক্ষ্ণতার হানি করেনি।”
অদ্ভুত কিছু নেশা ছিল জীবনে। প্ল্যানচেট করতেন ছোটো থেকেই। করতেন কোষ্ঠীবিচারও। সবদিকে নিজেকে খোঁজার এই চেষ্টা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়কেও ‘সত্যান্বেষী’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কিন্তু কখনোই চাননি ব্যোমকেশ চশমা পড়ুক। সিনেমায় যখন দেখলেন সেই চশমা পরিহিত ব্যোমকেশকে, রেগে গিয়েছিলেন রীতিমতো। প্রসঙ্গত, সেটি ছিল সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় ‘চিড়িয়াখানা’, ব্যোমকেশের ভূমিকায় উত্তমকুমার।
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত শরদিন্দুর সঙ্গী ছিল বয়সে মাত্র নয় বছরের ছোটো এই চরিত্রটি। ব্যোমকেশের নতুন একটি গল্পও লিখছিলেন, ‘বিশুপালবধ’। কিন্তু বধ করা আর হল না। অসম্পূর্ণ রেখেই চলে গিয়েছিলেন দীর্ঘদেহী মানুষটি। কে জানে, অসমাপ্ত সেই গল্পে নতুন কোনো প্লট, বা ইতিহাসের সন্ধান দিতেন হয়তো! নিজেই তো একসময় বলেছিলেন, “যে জাতির ইতিহাস নেই, সেই জাতির ভবিষ্যতও নেই।”
আজ সেই স্রষ্টার জন্মদিন | আজ শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের জন্মদিন |
ঋণ-
১) আনন্দবাজার পত্রিকা, ‘গোয়েন্দা কাহিনিকে সামাজিক উপন্যাসে উন্নীত করেছিলেন’
২) আনন্দবাজার পত্রিকা, ‘বোম্বাইয়ের ব্যোমকেশ, অচেনা শরদিন্দু এস ব্যানার্জি’
৩) অবসর, ‘অব্যর্থ ব্যোমকেশ’, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়