ট্রাম শুধু একটা গাড়ি নয়, কলকাতার ঐতিহ্য, আবেগ ও ইতিহাসের চলমান সাক্ষী। কল্লোলিনী তিলোত্তমা এবং ট্রাম যেন একে অপরের পরিপূরক। সম্পৃক্ত হয়ে আছে একে অপরের মধ্যে। এক থেকে অপরকে আলাদা করে ভাবা অসম্ভব। কলকাতার গর্বের মুকুটে এ – যেন এক বাড়তি পালক।
সকলেই হয়ত মানবেন যে, কলকাতা ও ট্রাম যেন সমার্থক। কবিবর রাতের কলকাতার রূপ বর্ণনায় লিখেছেন-
শেষ ট্রাম মুছে গেছে, শেষ শব্দ, কলকাতা এখন জীবনের জগতের প্রকৃতির অন্তিম নিশীথ । চারিদিকে ঘর বাড়ি পোড়ো-সাঁকো সমাধির ভিড়; সে অনেক …ক্লান্তি ক্ষয় অবিনশ্বর পথে ফিরে যেন ঢের মহাসাগরের থেকে এসেছে নারীর পুরোনো হৃদয় নব নিবিড় শরীরে।
লোকটা বেঁচে থাকতে ভীষণ ভাবুক ছিলেন বোঝা যায়। তা না হলে কেউ কি দিনে-দুপুরে ট্রামের নিচে পড়ে! ট্রামতো আর ছোটখাটো কোনো বস্তু নয় যে খেয়াল হবে না। তাছাড়া অবিরাম ঘণ্টা বাজানো ছাড়াও বারংবার সতর্কবাণী উচ্চারণ করছিল ট্রাম ড্রাইভার। তবু লোকটা ট্রামের নিচেই পড়লো। ট্রামের ক্যাচারে আটকে তার শরীর মুচড়ে গেলো। গুরুতর আহত লোকটার চিৎকার শুনে ছুটে আসে নিকটস্থ চায়ের দোকানের মালিক চূণীলাল।
আরো কয়েকজন মিলে ধরাধরি করে ক্যাচারের কঠিন কবল থেকে অতি কষ্টে টেনে-হিঁচড়ে বের করলো রক্তস্নাত মানুষটির অচেতন দেহ। কেটে, ছিঁড়ে থেঁতলে গেছে এখানে সেখানে। চুরমার হয়ে গেছে বুকের পাঁজর, ডান দিকের কন্ঠা আর উরুর হাড়। তাকে নিয়ে যাওয়া হলো হাসপাতালে। কিন্তু লাভ হয়নি। ৬৪ বছর আগের এই দিনে অর্থাৎ ২২ অক্টোবর মারা গেলেন তিনি।
কতটা ভাবুক হলে একটা মানুষ ট্রামের নিচে পড়ে মারা যেতে পারেন! কারণ গত একশ বছরে ট্রাম দুর্ঘটনায় কলকাতায় মৃত্যুর আর কোন তথ্য নেই । একজন লোকই মৃত্যুবরণ করেছেন ট্রামের আঘাতে। তিনি আর কেউ নন, কবি জীবনানন্দ দাশ।
‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে
মুখে হাসি বুকে বল তেজে ভরা মন
মানুষ হইতে হবে এই যার পণ’
আমাদের খুব পরিচিত এই কবিতাটির রচয়িতা কুসুমকুমারী দাশ ই ছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশের মা।
জীবনানন্দের বাবা ছিলেন সত্যানন্দ দাশগুপ্ত। জীবনানন্দ দাশ ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত বরিশাল শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাকে বাংলাভাষার “শুদ্ধতম কবি” বলা হয়।
ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে মৃত্যুর পর তিনি জনপ্রিয়তা শুরু করেন। বিংশ শতাব্দীর শেষে এসে দেখা যায় জীবিত থাকা কালে চরম হতাশা, গ্লানিতে ভোগা জীবনানন্দ মৃত্যুর পর বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয়তম কবিতে পরিণত হয়েছেন।
তিনি প্রধানত কবি হলেও নিভৃতে ২১টি উপন্যাস এবং ১০৮টি ছোটগল্প রচনা গ্রন্থ করেছেন যার একটিও তিনি জীবদ্দশায় প্রকাশ করেননি। সংক্ষেপে এই ছিলো তাঁর সাহিত্য নিয়ে কথা।
জীবনানন্দের কবিতা নিয়ে দিস্তার পর দিস্তা লেখা হয়েছে, তাকে নিয়ে গবেষণা হয়েছে, তার চরিত্র বনলতা সেনকে নিয়ে গবেষনা চলেছে-চলছে। তাই এগুলো নিয়ে আরো লেখার চেয়ে জীবনানন্দের জীবনের দিকেই বরং মনযোগ দেয়া যাক।
রবীন্দ্র-পরবর্তী সময়ে জীবনানন্দকেই প্রধান কবি হিসেবে স্বীকার করে নেয়া হয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মতো নির্বিঘ্ন জীবন তিনি পাননি। তাঁর জীবন কেটেছে চরম দারিদ্রের মধ্যে। তার সারাজীবনের সংগ্রামের কথাও নিতান্তই কম নয়।
জীবনানন্দ দাশকে বুঝতে হলে এমন একজন কবির চরিত্রকে কল্পনা করতে হবে যিনি ছিলেন অমিত প্রতিভাবান অথচ অর্থকষ্টে পীড়িত। কল্পনা করতে হবে এমন একজন মানুষকে যিনি কবিতাকে ভালোবাসেন, লিখতে ভালোবাসেন, কিন্তু বারবার পরাজিত হতে থাকেন। জীবনের অলিতে গলিতে চলার সময় লেখা নিয়ে ভাবতে ভাবতে যার পা কেটে যায় হোঁচট খেয়ে। কিন্তু তিনি থামেন না। ব্যথা পাওয়া জায়গায় হাত বুলিয়ে আবার উঠে দাঁড়ান।
চলতে শুরু করেন। কারণ তিনি জানেন তাকে তাড়া করে ফিরছে শকুনেরা। এমন অনেক রাত গেছে হয়ত তার মাথায় গিজগিজ করছে লেখা, কিন্তু তাকে রাত জেগে হারিকেনের বাতি জ্বেলে এর কাছে, ওর কাছে টাকা ধার চেয়ে লিখে যেতে হয়েছে চিঠি। একজন লেখকের লিখতে না পারার যে যন্ত্রণা তা কবির মগজকে নীরবে খেয়ে চলেছিলো, সাথে দুশ্চিন্তা-ক্লান্তিও কি পেয়ে বসেনি তাকে?
তবু শত সমস্যা স্বত্বেও তিনি লিখে গেছেন। কখনো একটু সুযোগ পেলেই তার কলম হয়ে উঠতো তুলি। আর তিনি কাগজের ক্যানভাসে এঁকে যেতেন কাব্যচিত্র। সেই চিত্র কল্পনা করে আজও আমরা মোহিত হই। আমাদের মনে প্রেম জাগে, আমরা সুখের সন্ধান পাই। অথচ যে মানুষটির হাত ধরে আমরা বনলতা সেনদের চোখে ডুব দেয়া শিখেছি, কি পরিমাণ কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে তাকে তা অনুমান কারার চেষ্টাও বোকামী।
তাঁর শেষজীবনের কথা বলা যাক। শেষ কয়েকবছর কবি জীবনানন্দ দাশ চরম অর্থকষ্টে ছিলেন। তুচ্ছ কারণে একটার পর একটা চাকরি হারিয়েছেন।
কলকাতার ১৮৩ নম্বর ল্যান্সডাউন স্ট্রিটের একটি ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। স্ত্রী লাবণ্য গুপ্তর অসুস্থতাসহ পুরো পরিবারের ভার, তাকে অস্থির এবং ক্রমশ অসহায় করে তুলেছিলো। নিদারুণ অর্থকষ্টে ভাড়াবাড়ির একটা ঘর সাবলেটও দিয়েছিলেন বেআইনিভাবে একজন নর্তকীর কাছে, যিনি কবি’র লেখা পড়ার পরিবেশ এবং সকল নৈঃশব্দ্য ভেঙে দিয়েছিলেন।
টিউশনি করেছেন, এমন কি বীমা কোম্পানির দালালি পর্যন্ত করেছেন। টাকা ধার করেছেন সম্ভব-অসম্ভব যে-কোনও সূত্র থেকে: ভাই-বোন, ভাইয়ের বউ, বীমা কোম্পানি, স্কটিশ ইউনিয়ন, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, সত্যপ্রসন্ন দত্ত, বিমলাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, বাণী রায়, প্রতিভা বসুসহ আরো অনেকের কাছ থেকে। শোধ করেছেন ভেঙে ভেঙে।
মৃত্যুর ছয় মাস আগে ‘স্বরাজ’ পত্রিকার সম্পাদক অধ্যাপক হুমায়ূন কবিরের কাছে জীবনানন্দ তিনটি চিঠি লিখেছিলেন। হুমায়ুন কবির বিরাট মানুষ- দুই দফায় ভারতের শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। সেই সাথে শিল্প সাহিত্যের সমঝদার। আমাদের দরিদ্র কবিটি হয়ত ভেবেছিলেন চিঠি দিলে একটা কিছু হয়েও যেতে পারে। কিন্তু না; একটি চিঠিরও জবাব পর্যন্ত মেলেনি।
প্রথম চিঠিটি লিখেছিলেন ছোট করে। হয়ত আশা করেছিলেন এতেই কাজ হয়ে যাবে। মন্ত্রীর ক্ষমতার অসাধ্যতো কিছু নেই। অল্প কথাতেই কাজ হয়ে যাবে।
১৭.৩.৫৪
আমার প্রিয় মিস্টার কবির,
আপনি এখন একটা খুব প্রভাবশালী জায়গায় আছেন। শিক্ষা, সাংস্কৃতিক সম্পর্ক, সাহিত্য, প্রকাশনা এবং অন্যান্য অনেক বিষয় আপনার সাক্ষাৎ তত্ত্বাবধানে আছে, যাদের মাধ্যমে আপনি আমাকে কোনও একটা উপযুক্ত চাকরিতে বসিয়ে দিতে পারেন।
দয়া করে কিছু একটা করুন এক্ষুনি। আশা করে রইলাম তাড়াতাড়ি করে আপনি আমাকে কিছু জানাবেন।
শুভেচ্ছা এবং শ্রদ্ধা নিবেদন-সহ
আপনার জীবনানন্দ দাশ
কাজ হয় না। চিঠির উত্তর পর্যন্ত আসে না। এদিকে ঝামেলা বাড়ছেই। কবি বুঝলেন এত কম কথায় হবে না। আমাদের দরিদ্র কবি মাসখানেক পর সবটুকু কাকুতি-মিনতি জানিয়ে লিখলেন দ্বিতীয় চিঠিটি-
১৬.৪.৫৪
আমার প্রিয় অধ্যাপক কবির,
বিশিষ্ট বাঙালিদের ভিতর আমি পড়ি না; আমার বিশ্বাস, জীবিত মহত্তর বাঙালিদের প্রশ্রয় পাওয়ার মতনও কেউ নই আমি। কিন্তু আমি সেই মানুষ, যে প্রচুর প্রতিকূলতা সত্ত্বেও প্রতিটি দ্রব্যকে সোনা বানিয়ে তুলতে চাই অথবা মহৎ কোনও কিছু – যা শেষ বিচারে একটা কোনও জিনিসের-মতন-জিনিস; – কিন্তু, ভাগ্য এমনই যে, আজ তার পেটের-ভাত জুটছে না।
কিন্তু, আশা করি, একটা দিন আসবে, যখন খাঁটি মূল্যের যথার্থ ও উপযুক্ত বিচার হবে; আমার ভয় হয়, সেই ভালো দিন দেখতে আমি বেঁচে থাকব না।
আপনার কথা-মতো আমি জ্যোতিবাবুর অথবা বি.সি. রায়’এর সঙ্গে এখনও দেখা করার চেষ্টা করি নি; আমার মনে হয়, আমার মতন মানুষের পক্ষে তাঁরা দূরের মানুষ। আমি যেন অনুভব করি, আপনিই আমাদের মতন লোকের জন্য এক-মাত্র মানুষ; আপনার উপর আমার গভীর আস্থা আছে।
আমি সর্বদা বিশ্বাস করি যে, আপনার নিজের পরিপূর্ণ শাসনের ভিতরে আছে, এমন কোনও একটা, আমার পক্ষে মানানসই, জায়গায় আপনি আমাকে বসিয়ে দিতে পারেন; আমাকে একটা উপযুক্ত কাজ দিয়ে দেবার মতন সুযোগ-সুবিধা আপনার খুবই আছে। আমার আর্থিক অবস্থাটা এখন এতটাই শোচনীয় যে, যেকোনো একজন সকর্মক ‘অপর’ মানুষ যে-কাজ করতে পারে, কেন্দ্রীয় সরকার’এর অধীনে সে-কাজ আমারও করতে পারা উচিত।
আমি মনে করি, এ-রকম একটা কাজ এক জন মানুষকে সেই সম্মানটা দিয়ে দিতে পারে, যা প্রতিটি মানুষ নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলে অর্জন করে নেয়; তার বেশি আমি আর কিছু চাই না। আমার দেশ আমার অস্তিত্বের স-র-মাত্রাটার সাপেক্ষে সেই যথাযোগ্য সুযোগটা আমাকে দিক, যাতে আমি আমার ন্যূনতম জীবনযাপন নিয়ে থেকে যেতে পারি।
প্রাইভেট কলেজের অধ্যাপকের কাজ ক্ষুদ্র কাজ : অধিকন্তু অন্যান্য নানা কারণেও ওই কাজটা আমি আর করতে চাই না। আমার খুবই পছন্দ তেমন কোনও একটা মানানসই কাজ, যাতে অনেকটা গবেষণা করতে হয়, লিখতে হয় এবং ভাবনা-চিন্তা করতে হয়।
ইতি
আপনার জীবনানন্দ দাশ
কয়দিন পর লেখেন তৃতীয় চিঠিটিও। কিন্তু অধ্যাপকের কানে দরিদ্র কবির দুর্বল কণ্ঠস্বর হয়তো পৌঁছায় না। কোনো সাহায্য আসে না। আসে না কোনো সাহসের প্রতিশ্রুতিও। কবি হলেওতো তিনি একজন মানুষ। ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে কতটা ভাঙ্গা যায়। মানসিকভাবে না হোক, শরীরটা একদিন ভেঙ্গে পড়লো এক ট্রামের নিচে। অথচ ট্রামটিকে খুনী বলা যায় না। দয়া করে ট্রামটিই কি মুক্তি দিয়ে গেলো না কবিকে? কে জানে।
আবার ফিরে এলাম ট্রামের কাছে। ট্রাম দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীর মতে এ সময় দুই হাতে দুই থোকা ডাব নিয়ে ট্রাম লাইন পার হচ্ছিলেন কবি। ডাব নিয়ে কেউ আত্নহত্যা করতে যায় না।
তবু অনেক গবেষক একে আত্নহত্যা কিংবা স্বেচ্ছামৃত্যু হিসেবে দেখতে চান। যদিও এর কোনো নিশ্চিত সত্যতা নেই। তবে জীবনানন্দ মৃত্যু নিয়ে ভাবতেন খুব। এমনকি তিনি ট্রাম দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যুর সম্ভবনার কথাও বলতেন পরিচিতদের। তবে সত্যতা যাই হোক, এটা এক ধরণের খুন। সমাজ কর্তৃক একজন লেখককে খুন, দারিদ্র দিয়ে একজন কবিকে খুন।
জীবনানন্দ বেঁচে থাকবে আরও হাজারকাল, এ কথা নতুন করে বলা অর্থহীন। জীবনানন্দ দাশ নামটি আসলে দুই ধরণের কবিতা- একটা হচ্ছে তাঁর লেখা কবিতা, আর ব্যক্তি জীবনানন্দের জীবন নিজেই একটি কবিতা। যে কবির জীবনও কবিতা, তাঁর তো মরে যাবার প্রশ্নই ওঠে না।